“আর একটা সিগারেট। ব্যস, আজকেই শেষ। কাল থেকে পাক্কা বন্ধ।” “আজ রাতটা জেগে সিরিজটা শেষ করি। কাল থেকে যেভাবেই হোক, রাত ১২টার আগে ঘুমাবো।” “এই শেষবার ফাস্ট ফুড খেলাম। সামনের শনিবার থেকে শুধু হেলদি ডায়েট!”
এই কথাগুলো কি খুব পরিচিত লাগছে?
আমরা সবাই জীবনের কোনো না কোনো ধাপে বুক চাপড়ে এমন প্রতিজ্ঞা করি। খুব জোশ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিই যে, ব্যস! আর না। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, দুই-তিন দিন যেতে না যেতেই, ঠিক সেই পুরনো অভ্যাসেই ফিরে যাই।
তখন শুরু হয় নিজেকে দোষ দেওয়া। “আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না,” “আমার কোনো ইচ্ছাশক্তিই (Willpower) নেই,” “আমি একটা লুজার”। এই হতাশাটা আমাদের আরও বেশি করে পুরনো অভ্যাসের দিকে ঠেলে দেয়।
কিন্তু যদি বলি, সমস্যাটা আপনার নয়? সমস্যাটা আপনার ইচ্ছাশক্তিরও নয়। সমস্যাটা হলো আপনার অভ্যাস পরিবর্তনের পদ্ধতিতে।
আজ আমরা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখব কেন আমাদের “আজকেই শেষ” প্রতিজ্ঞাগুলো কাজ করে না এবং কীভাবে আসলেই কোনো অভ্যাস স্থায়ীভাবে পরিবর্তন করা যায়।
ইচ্ছাশক্তি কেন বারবার হেরে যায়? (পেছনের বিজ্ঞান)
আমরা ভাবি, অভ্যাস বদলানো মানে ইচ্ছাশক্তির এক বিশাল যুদ্ধ। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, এই ধারণাটাই ভুল।
১. ইচ্ছাশক্তি হলো ফোনের ব্যাটারির মতো: আপনার ইচ্ছাশক্তি বা Willpower অসীম নয়। এটা ঠিক আপনার স্মার্টফোনের ব্যাটারির মতো। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর এটা ১০০% থাকে। কিন্তু সারাদিন ধরে ছোট ছোট সিদ্ধান্ত নিতে নিতে এর চার্জ শেষ হতে থাকে।
ভাবুন তো, আপনি সকালে ঘুম থেকে উঠে ঠিক করলেন আজ আর ফাস্ট ফুড খাবেন না। কিন্তু এরপর আপনি ২ ঘণ্টা ঢাকার জ্যাম ঠেললেন (ধৈর্য ধরে ইচ্ছাশক্তি খরচ হলো), অফিসে বসের বকা খেলেন (রাগ নিয়ন্ত্রণ করে ইচ্ছাশক্তি খরচ হলো), এরপর সারাদিন কঠিন কাজ করলেন।
দিনের শেষে, যখন আপনি ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত, তখন আপনার ইচ্ছাশক্তির ব্যাটারি ১০% এ নেমে এসেছে। এই সময়টার জন্যই ফাস্ট ফুড কোম্পানিগুলো তাদের বিজ্ঞাপন দেয়। এই দুর্বল মুহূর্তে, আপনার সামনে যদি এক প্লেট বিরিয়ানি বা একটা বার্গার আসে, তখন শুধু ইচ্ছাশক্তির জোরে নিজেকে আটকানো প্রায় অসম্ভব।
২. আপনার মস্তিষ্ক “অটো-পাইলট” পছন্দ করে: আমাদের মস্তিষ্ক খুব অলস। সে শক্তি বাঁচাতে ভালোবাসে। তাই সে প্রতিদিনের কাজগুলোকে অভ্যাসে পরিণত করে “অটো-পাইলট” মোডে চলে যায়। যেমন: আপনি দাঁত ব্রাশ করার সময় ভাবেন না, বা জুতার ফিতা বাঁধার সময় মনোযোগ দেন না।
প্রতিটি অভ্যাসের একটি চক্র বা ‘লুপ’ আছে:
- সংকেত (Cue): যা আপনাকে কাজটা করতে মনে করিয়ে দেয়।
- কাজ (Routine): সেই অভ্যাসটি (যেমন: সিগারেট ধরানো)।
- পুরস্কার (Reward): কাজটা করার পর যে ভালো লাগার অনুভূতি হয়।
আপনি যখন বলেন “আজকেই শেষ”, আপনি শুধু ‘কাজ’ (Routine) বন্ধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এর পেছনের ‘সংকেত’ বা ‘পুরস্কার’-কে বদলান না। তাই মস্তিষ্ক বারবার পুরনো পথেই ফিরে যায়।
৩. “সবকিছু অথবা কিছুই না” (All or Nothing) মানসিকতা: আমরা বিশাল লক্ষ্য ঠিক করি। “কাল থেকে প্রতিদিন ১ ঘণ্টা জিমে যাব।” বা “একদম চিনি খাওয়া বন্ধ।” দু-দিন করার পর, তৃতীয় দিন হয়তো কোনো দাওয়াতে গিয়ে এক টুকরো মিষ্টি খেয়ে ফেললেন। অমনি আপনার মনে হবে, “ধুর! সব শেষ। প্রতিজ্ঞা ভেঙে গেছে। আমাকে দিয়ে আর হবে না।”
এই পারফেক্ট হতে চাওয়ার মানসিকতাই অভ্যাস নষ্ট করার মূল কারণ।
মূল উপলব্ধি: আপনি ব্যর্থ নন, আপনার “সিস্টেম” দুর্বল
এটাই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা। আপনি প্রতিজ্ঞা ভাঙেন কারণ আপনার ইচ্ছাশক্তির ওপর ভরসা করাটা একটা দুর্বল সিস্টেম।
সহজ উদাহরণ: আপনি ঠিক করলেন প্রতিদিন সকালে উঠে বই পড়বেন। কিন্তু আপনার বই থাকে আলমারির ভেতরে, আর ফোন থাকে বিছানার পাশে। সকালে উঠেই আপনার হাত ফোনের দিকে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ ফোন পাওয়াটা সহজ আর বই বের করাটা কঠিন।
এখানে আপনার ইচ্ছাশক্তি কম না, আপনার পরিবেশ বা ‘সিস্টেম’ ভুলভাবে ডিজাইন করা।
অভ্যাস পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক উপায় (যা আসলেই কাজ করে)
ইচ্ছাশক্তির ওপর ভরসা না করে, আসুন এমন একটি সিস্টেম তৈরি করি যা আমাদের সফল হতে বাধ্য করবে।
১. “১% ভালো” নীতি (The 1% Better Rule)
বিশাল লক্ষ্য (“কাল থেকে ১ ঘণ্টা ব্যায়াম”) বাদ দিন। এর বদলে এমন ছোট লক্ষ্য নিন যা ‘না’ বলাটাই কঠিন।
- ভুল লক্ষ্য: কাল থেকে প্রতিদিন ৩০ পৃষ্ঠা বই পড়ব।
- সঠিক লক্ষ্য: কাল থেকে প্রতিদিন মাত্র ১ পৃষ্ঠা বই পড়ব।
- ভুল লক্ষ্য: কাল থেকে প্রতিদিন সকালে দৌড়াব।
- সঠিক লক্ষ্য: কাল থেকে প্রতিদিন সকালে শুধু জুতাটা পরে ৫ মিনিট হাঁটব।
এটা শুনতে খুব সামান্য মনে হতে পারে, কিন্তু এটাই ম্যাজিক। এক মাস প্রতিদিন ১ পৃষ্ঠা পড়লে ৩০ পৃষ্ঠা পড়া হয়। কিন্তু “৩০ পৃষ্ঠা পড়ব” এই ভয়ে আপনি হয়তো শুরুই করবেন না। মূল লক্ষ্য অভ্যাসটি শুরু করা, নিখুঁতভাবে করা নয়।
২. পরিবেশ ডিজাইন করুন (খারাপ অভ্যাসকে কঠিন বানান)
ইচ্ছাশক্তির সাথে যুদ্ধ করবেন না। পরিবেশকে নিজের পক্ষে কাজে লাগান।
- উদাহরণ ১: সকালে উঠতে চান? অ্যালার্ম ক্লক বা ফোন বিছানার পাশে না রেখে রুমের অন্য কোণায় রাখুন। অ্যালার্ম বন্ধ করতে আপনাকে বিছানা থেকে উঠতে বাধ্য হতেই হবে।
- উদাহরণ ২: ফাস্ট ফুড খাওয়া কমাতে চান? ফ্রিজে অস্বাস্থ্যকর খাবারের বদলে ফল কেটে বাক্সে ভরে রাখুন। যখন ক্ষুধা লাগবে, তখন ফল খাওয়াটা বার্গার অর্ডার করার চেয়ে সহজ মনে হবে।
- উদাহরণ ৩: রাত জেগে ফোন ব্যবহার বন্ধ করতে চান? রাত ১১টায় ফোনের চার্জার বেডরুমের বাইরে অন্য রুমে রাখুন।
৩. অভ্যাসকে আকর্ষণীয় করুন (Habit Loop Hacking)
আপনার মস্তিষ্ককে বোকা বানান।
- উদাহরণ: আপনি কি বোরিং লাগলে (সংকেত) ফেসবুক স্ক্রল করেন (কাজ) কারণ এটা আপনাকে তাৎক্ষণিক আনন্দ দেয় (পুরস্কার)?
- নতুন সিস্টেম: ঠিক করুন, বোরিং লাগলে (সংকেত) আপনি আপনার পছন্দের কোনো ভালো লেখকের ৫ মিনিট পডকাস্ট শুনবেন (নতুন কাজ), যা আপনাকে একই আনন্দ বা বিরতি দেবে (পুরস্কার)। আপনি মূল ‘সংকেত’ বা ‘পুরস্কার’ বদলাচ্ছেন না, শুধু মাঝখানের ‘কাজ’টা বদলে ফেলছেন।
৪. “কখনোই টানা দুইবার মিস নয়” (Never Miss Twice)
“সবকিছু অথবা কিছুই না” মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসুন। আপনি মানুষ, রোবট নন। আপনার রুটিন মিস হবেই।
- একদিন জিম মিস করেছেন? কোনো সমস্যা নেই। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু নিজেকে বলুন, “যাই ঘটুক, আমি টানা দুইদিন জিম মিস করব না।”
- একদিন মিস হওয়াটা একটা ভুল, কিন্তু টানা দুইদিন মিস হওয়াটা একটা নতুন (খারাপ) অভ্যাসের শুরু। এই এক দিনের গ্যাপ আপনাকে আবার ট্র্যাকে ফিরতে সাহায্য করবে।
শেষ কথা
“আজকেই শেষ” বলাটা একটা আবেগি সিদ্ধান্ত। কিন্তু অভ্যাস বদলানো কোনো আবেগি ঘটনা নয়, এটি একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া।
আপনার লক্ষ্য সিগারেট ছাড়া নয়, আপনার লক্ষ্য হলো সেই ব্যক্তি হওয়া যার সিগারেটের প্রয়োজনই হয় না। আপনার লক্ষ্য জিমে যাওয়া নয়, আপনার লক্ষ্য হলো সেই ব্যক্তি হওয়া যিনি সচল থাকতে ভালোবাসেন।
তাই, পরেরবার হতাশ হয়ে প্রতিজ্ঞা না করে, শুধু ভাবুন, “কাল কীভাবে এই কাজটা মাত্র ১% সহজ বা আকর্ষণীয় করতে পারি?”
আপনার ফোকাস হোক প্রক্রিয়ার ওপর, নিখুঁত ফলাফলের ওপর নয়।